ঠাকুরগাঁওয়ের সেই সাগরিকা এখন নারী ফুটবলে আলো ছড়াচ্ছেন

ঠাকুরগাঁওয়ের মোসাম্মৎ সাগরিকা। প্রত্যন্ত গ্রামে কুঁড়েঘরে বেড়ে ওঠা মেয়েটি এখন নারী ফুটবলে আলো ছড়াচ্ছেন। সেই আলো বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে আলোকিত করছে সারাবিশ্ব। সাফ অনূর্ধ্ব-২০ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে দুটি হ্যাটট্রিক তার। নেপালের বিপক্ষে অঘোষিত ফাইনালে চার গোল। চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে সাগরিকাকে। দরিদ্র ঘরে বেড়ে ওঠা এই মেয়ে সংগ্রাম করে উঠে এসেছেন। এখন তিনি বাংলাদেশের নারী ফুটবলের বড় বিজ্ঞাপন। ২০২২ সালে প্রথম সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতে ইতিহাস গড়েছিলেন বাংলার মেয়েরা।

দুই বছর পর হিমালয়কন্যাদের ২-১ গোলে হারিয়ে টানা দ্বিতীয় শিরোপা জয় করে নতুন ইতিহাস গড়েছে লাল-সবুজের মেয়েরা। সেই দলের গর্বিত সদস্য সাগরিকার বেড়ে ওঠা রাণীশংকৈল উপজেলার অজপাড়াগাঁয়ে রাঙ্গাটুঙ্গী গ্রামের একটি ফুটবল একাডেমিতে।

নেপালের বিপক্ষে অঘোষিত ফাইনালে চার গোল করেছিলেন সাগরিকা। ছবি: বাফুফে

সাগরিকার বাবার একটি চায়ের দোকান রয়েছে। দুই সন্তানের মধ্যে সাগরিকা ছোট। ভাই মোহাম্মদ সাগর ইটের ভাটায় কাজ করেন।

সাগরিকার বাবা লিটন জানান, ‘মেয়েদের ফুটবল দেখে অনেকেই কটূক্তি করতেন। তাদের কথায় বিরক্ত হয়ে মেয়েকে মাঠে যেতে বারণ করে ঘরে আটকে রাখতাম। এসব উপেক্ষা করে মাঠে চলে যেত সাগরিকা।’

একসময় রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা তাজুল ইসলামের অনুরোধ আর উপেক্ষা করতে পারেননি সাগরিকার বাবা-মা। বয়সভিত্তিক দলে তাকে টানেন তৎকালীন কোচ গোলাম রব্বানী। সেসময় তার শারীরিক গঠন ফুটবল উপযোগী ছিল না। কোচ অনেকটা জোর করে ক্যাম্পে নেন।

কোচ রব্বানী নিজেকে সফল মনে করেন। তিনি বলেন, ‘সাগরিকার খেলা দেখে ভালো লেগে যায়। তখনই বুঝতে পেরেছিলাম ঠিকমতো পরিচর্যা করলে দেশের ফুটবলে একদিন সম্পদ হবে সে। সাগরিকা তার পারফরম্যান্স দিয়ে সবাইকে আনন্দে ভাসিয়েছে। দেখে অনেক ভালো লাগছে। নারী ফুটবলে বড় তারকা হবে, এমন প্রত্যাশা করাই যায়।’

নিজের ফুটবলে আসা নিয়ে অনেক সংগ্রামের কথা জানান সাগরিকা, ‘মানুষ এখন চিনতে পারে আমাকে। আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকায়। একটু যেন কেমন-কেমন লাগে। ব্যাপারটাতে আমি অভ্যস্ত নই। একটু লজ্জাই লাগে।’

তিনি যোগ করেন, ‘অনূর্ধ্ব-১৭ ও ১৯ পেরিয়ে আমার লক্ষ্য জাতীয় দল। আমাদের জাতীয় দল খুবই ভালো। সেখানে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করা ছাড়া জায়গা পাওয়া খুবই কঠিন। আমাকে এখন প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হবে।’

সাগরিকার পরিবারের জন্য দুকক্ষের নতুন বাড়ি করা হয়েছে। ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার রাঙ্গাটুঙ্গী গ্রামে সাগরিকার পরিবার অন্যের জমিতে একটি জরাজীর্ণ বাড়িতে কষ্ট করে বসবাস করত। সাগরিকার মা আনজু আরা বলেন, ‘নিজের বসতভিটাটুকুও নেই।

সাগরিকার কারণেই আজ নতুন বাড়ি পাচ্ছি।’ বাবা লিটন আলী জানান, ‘অন্যের বলতে উকিল নামে এক ব্যক্তির এই জমি। কিন্তু তার পক্ষে কোনো দাবিদার না থাকায় আমরা এই জমিতে কোনোরকমে খড়কুটোর বেড়া আর টিনের ছাউনি দিয়ে বাড়ি বানিয়েছিলাম। সাগরিকার জন্য পাকা বাড়ি পাচ্ছি। আগে মেয়েকে খেলতে নিষেধ করতাম; এখন গর্ব হচ্ছে।’

গর্বিত সাগরিকাও, ‘দলকে জেতাতে পেরেছি। মানুষ প্রশংসা করছে। খুব ভালো লাগছে। এর আগে আমি অনূর্ধ্ব-১৭ দলে খেলেছি। মেয়েদের এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের প্রথম রাউন্ডে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হই সিঙ্গাপুরে। দ্বিতীয়পর্বে পেরে উঠিনি। ভিয়েতনামে সব ম্যাচ হেরে বিদায় নিয়েছিলাম। তখন খুব মন খারাপ হয়েছিল। কারণ, অনূর্ধ্ব-১৭ দলের হয়ে ওটাই আমার শেষ টুর্নামেন্ট ছিল। এরপরই ১৯-এর ক্যাম্পে আসি। সেবারই প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। এর চেয়ে আনন্দের আর কী আছে। তবে আনন্দটা বেশি হতো যদি একক চ্যাম্পিয়ন হতে পারতাম।’

সাগরিকা হয়েছেন টুর্নামেন্টের মোস্ট ভ্যালুএবল খেলোয়াড়। ছবি: বাফুফে

এই ফরোয়ার্ড যোগ করেন, ‘আমি ভালো খেলে বাবা-মা’র মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি। তারা একসময় ফুটবলই দেখতেন না। এখন আমার কারণে সব খেলা দেখেন। আমাকে অনেক সমর্থন করেন। শুরুর দিকে পরিস্থিতি এমন ছিল না। আমরা সচ্ছল পরিবার নই। বাবা চা বিক্রেতা। আমাদের এলাকায় তাজু স্যার (তাজুল ইসলাম) মেয়েদের ফুটবল নিয়ে কাজ করেন।

রাঙ্গাটুঙ্গীতে তার ফুটবল একাডেমিতে অনেক মেয়ে ফুটবল শেখে। সেটা দেখে আমারও খেলার ইচ্ছে জাগে। বাবা চাইতেন না আমি খেলি। তার কথা, মেয়েরা হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেলবে, লোকে কী বলবে? বিয়ে দেওয়া যাবে না। তবে আমি ছিলাম নাছোড়বান্দা। মায়ের অবশ্য সায় ছিল। তবে বাবা কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিলেন না। তখন আমার এক খালা বাবা-মা’কে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বলেন, আমার তো কোনো মেয়ে নেই। এই মেয়েটা আমাকে দিয়ে দে। আমি ওকে লালন-পালন করব, লেখাপড়া করাব এবং অবশ্যই বড় ফুটবলার বানাব। আমিও খুব করে চাইতাম ফুটবলার হতে। একসময় বাবার মন গলে। আমি তাজু স্যারের অধীনে খেলা শুরু করি। বাবা এখন আমার খেলা নিয়ে এতটাই আগ্রহী যে, টুর্নামেন্ট চলাকালে পাশের গ্রামের আমার এক খালার কাছ থেকে টিভি ধার এনে দোকানে লাগিয়েছেন। সেখানে বাবা ছাড়াও অনেকে নাকি খেলা দেখেছেন। আমার গ্রামে নাকি বড় পর্দায় আমার খেলা দেখানো হয়েছে।’

দক্ষিণ  এশিয়ায় সেরা সাগরিকাদের লক্ষ্য এশিয়ার মঞ্চে। ছবি: বাফুফে

সাগরিকা জানান, ‘তাজুল স্যার আমাকে হাতে-কলমে ফুটবল শিখিয়েছেন। তার কাছে এক বছর ফুটবল পাঠ নেওয়ার পর তিনি আমাকে বিকেএসপিতে ট্রায়াল দিতে নিয়ে আসেন। ট্রায়ালে আমি টিকে যাই। তবে ছয় মাস সেখানে থাকার পর আর ভালো লাগছিল না। তখন বাড়ি ফিরে যাই। সেসময় বাবা অনেক রাগ করেছিলেন। বলেছিলেন, এত ভালো পরিবেশ ছেড়ে ফিরে আসা ঠিক হয়নি। তাজুল স্যারও আফসোস করছিলেন। স্যারকে বলেছিলাম, আপনার এখানে থেকেই একদিন ভালো খেলতে শুরু করব। স্যার আমার ওপর আস্থা রাখেন। এরপর ২০২২ সালে নারী লিগে খেলি। আমার খেলা দেখে জাতীয় দলের সাবেক কোচ গোলাম রব্বানী স্যারের ভালো লেগে যায়। তিনি আমাকে ক্যাম্পে নিয়ে আসেন।’

কোচ রব্বানীর অবদান স্বীকার করে সাগরিকা বলেন, ‘আমার বড় ফুটবলার হয়ে ওঠার পেছনে স্যারের অনেক বড় ভূমিকা। কতটা, বলে বোঝানো যাবে না। শুধু বলব, রব্বানী স্যারের সঙ্গে দেখা না হলে আমি ফুটবলার হতে পারতাম না। তিনি আমাকে এই পর্যায়ে নিয়ে আসতে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করেছেন। অথচ, স্যারের সঙ্গে বেশি দিন কাজ করার সৌভাগ্য আমার হলো না।’

নিজের খেলা সম্পর্কে সাগরিকার কথা, ‘আমরা প্রত্যেকেই স্বপ্ন দেখি বড় ফুটবলার হওয়ার। দেশের প্রতিনিধিত্ব করার। একদিন হয়তো আমিও সুযোগ পাব। তার আগে আমাকে নিজের সঙ্গে লড়তে হবে। এখন ভাবনায় শুধুই আরও উন্নতি করা। আমার মনে হয়, গতি আর বক্সে বল পেলে ফিনিশিংটা আমার শক্তি। দুর্বলতা ড্রিবলিংয়ে। এই জায়গাটায় আমাকে অনেক কাজ করতে হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *