গ্রাফিতি যা বলেছিল, বলছে কী তা বাংলাদেশ?

শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী ও গবেষকেরা মনে করছেন, গ্রাফিতির মধ্য দিয়ে মানুষ যা বলতে চেয়েছে, সেই ভাষাও রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের বোঝা জরুরি। ঢাকার বিভিন্ন দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতি ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা’ আলোড়ন তুলেছিল আট বছর আগে। আর গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার বিজয়ের পর সেই সুবোধকে কেবল ফিরিয়েই আনা হয়নি, তাকে আজীবন এই বাংলায় থেকে যাওয়ার আকুতি জানানো হয়। শেওড়াপাড়া মেট্রো স্টেশনের পাশেই একটি পিলারে ২০২৪ সালেল অগাস্টে একটি গ্রাফিতিতে লেখা হয়েছিল, ‘সুবোধ তুই আর পালাস না, থেকে যা আজীবন।’ সেই ছবি এখনও আছে মেট্রো স্টেশনের দেয়ালে। তবে রং যেন ফিকে হয়ে গেছে। কাজীপাড়া থেকে শেওড়াপাড়া হয়ে আগারগাঁও পর্যন্ত গেলে চোখে পড়বে এমন শতাধিক গ্রাফিতি, যার রং ফিকে হলেও জ্বলজ্বল করছে জন-আকাঙ্ক্ষার বার্তা। দেশেজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় এমন অসংখ্য গ্রাফিতি বা দেয়ালচিত্র ছড়িয়ে আছে। শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী ও গবেষকেরা মনে করছেন, সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের অংশ হিসেবে গ্রাফিতিগুলো সংরক্ষণে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। একই সঙ্গে গ্রাফিতির মধ্য দিয়ে মানুষ যা বলতে চেয়েছে, সেই ভাষাও রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের বোঝা জরুরি। শেওড়াপাড়া মেট্রো স্টেশনের পাশেই একটি পিলারে গত বছরের অগাস্টে একটি গ্রাফিতিতে লেখা হয়েছিল, ‘সুবোধ তুই আর পালাস না, থেকে যা আজীবন’। জুলাই অভ্যুত্থানের আট দিন পর ১৩ অগাস্ট তোলা হয়েছিল ছবিটি। শেওড়াপাড়া মেট্রো স্টেশনের পাশেই একটি পিলারে গত বছরের অগাস্টে একটি গ্রাফিতিতে লেখা হয়েছিল, ‘সুবোধ তুই আর পালাস না, থেকে যা আজীবন’। জুলাই অভ্যুত্থানের আট দিন পর ১৩ অগাস্ট তোলা হয়েছিল ছবিটি। শেওড়াপাড়া মেট্রো স্টেশনের পিলারে সুবোধকে নিয়ে সেই গ্রাফিতি এখনও আছে; তবে রং যেন ফিকে হয়ে গেছে, পাশে বসেছে পোস্টার। শেওড়াপাড়া মেট্রো স্টেশনের পিলারে সুবোধকে নিয়ে সেই গ্রাফিতি এখনও আছে; তবে রং যেন ফিকে হয়ে গেছে, পাশে বসেছে পোস্টার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলছিলেন, “দেয়ালে স্লোগান লেখা দীর্ঘদিনের চর্চা হলেও, তা মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই দেখা যেত। “কিন্তু চব্বিশের জুলাই সবার কথা প্রকাশের নতুন একটি জায়গা তৈরি করে দিয়েছে।” দেয়ালচিত্রের এই ব্যাপক ব্যবহার ‘জুলাইয়ের একটি অবদান’ এবং তা সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন তিনি। জুলাই অভ্যুত্থানের পরপরই দেয়ালে আঁকা বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময় গ্রাফিতির ছবি-সংবলিত একটি আর্ট বুকও প্রকাশ হয় সরকারের তরফে। প্রধান উপদেষ্টা বিদেশ সফরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে কিংবা দেশে আসা বিদেশি অতিথিকে সেই আর্ট বুক উপহার দিচ্ছেন। গ্রাফিতির ঐতিহাসিক তাৎপর্য তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, “এসব গ্রাফিতিতে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পাশবিক শক্তিকে প্রতিহত করতে নৃশংস এক বাহিনীর মুখোমুখি আন্দোলন-বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী ও যুবকদের দাবি-দাওয়া, আবেগ-অনুভূতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা চিত্রিত হয়েছে।” শিল্পকলা একাডেমির পরিচালনা পরিষদের সদস্য আজাদ আবুল কালাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেয়ালে দেয়ালে যে গ্রাফিতি আঁকা হয়েছিল, তা এক বিরল ইতিহাসের অংশ। মানুষ পুরো দেশকেই ক্যানভাস বানিয়ে তাদের আশা-প্রত্যাশার কথা বলেছে।” দেশ কি সবার হয়েছে? তবে গ্রাফিতিতে অসাম্প্রদায়িক, উদারনৈতিক এবং বৈষম্যহীন বাংলাদেশের যে স্বপ্ন আঁকা হয়েছে, তা পূরণ হয়নি বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশ ‘উল্টোদিকে’ হাঁটছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও সর্বজন কথার সম্পাদক আনু মুহাম্মদ বলেন, “বৈষম্যহীন বাংলাদেশের প্রত্যাশার শক্তি নিয়েই জুলাই গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল।” যারা বৈষম্যবাদী মতাদর্শ ধারণ করে; যারা শ্রেণি-লিঙ্গ-জাতি-ধর্মীয় বৈষম্য, জুলুম ও আধিপত্যের রাজনীতির দাপট তৈরি করতে চায়, তাদের ‘অভ্যুত্থানের শত্রুপক্ষ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি। বলেন, “তাদের বিপরীতে বৈষম্য, জুলুম ও আধিপত্যমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথ নির্মাণে জনগণের শক্তি জোরদার করাই এই সময়ের দাবি।” গ্রাফিতি কী বলেছিল শেওড়াপাড়া মেট্রোলাইনের পিলারে ২০২৪ সালের অগাস্টে বাংলাদেশের পতাকা এঁকেছিল মণিপুর স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী প্রিয়ন্তি, আলভিনা, তাবাসসুম, নুসাইবা। গত অগাস্টে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল তাদের কথা। এই ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা দেয়ালে লিখেছিল–‘ধর্ম যার যার দেশ সবার’। রাজধানীর দেয়ালে দেয়ালে তখন আঁকা হয়েছিল ছাত্র আন্দোলনে প্রাণ দেওয়া আবু সাঈদ, মুগ্ধদের প্রতিকৃতি। অনেক দেয়ালে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয় কালজয়ী সব কবিতা আর গানের বাণীতে। বিভিন্ন জেলাতেও ছড়িয়ে পড়ে ছবি আঁকার এই উন্মাদনা। তারুণ্যের এইসব প্রতিবাদী ভাবনা কেবল দেয়ালে আটকে থাকে না, আলোকচিত্র হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ইন্টারনেটে। কোথাও লেখা, ‘নতুন বাংলাদেশ’, কোথাও আবার ‘আমরা করবো জয়’ লেখা হয়েছিল। ‘পানি লাগবো পানি’, ‘স্টপ কিলিং’– এমন নানা কথায়, স্লোগানে অন্য রূপ পায় মেট্রোরেলের পিলারগুলো। আশপাশের বিভিন্ন দেয়ালেও আঁকা হয় ছবি। কোথাও পাখি উড়ে যাওয়ার দৃশ্যে মুক্তির আনন্দ; কোথাও বিশুদ্ধ রাজনৈতিক স্লোগানে অর্গল ভাঙার গান। দ্রোহ, মুক্তির এসব চিত্রকর্ম দেখে এই প্রজন্মের রাজনৈতিক ভাবনা বোঝার তাগিদ এসেছিল মানুষের কাছ থেকে। ধানমন্ডির একটি দেয়ালে লেখা হয়েছিল–‘এই শহর হোক সকল প্রাণের।’ সেই গ্রাফিতির ছবি অনেকেই তখন ফেইসবুকে শেয়ার করেছিলেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক ও চিত্রশিল্পী রশীদ আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জুলাই অভ্যুত্থানের পর ঢাকার বাইরে কয়েকটা জেলায় গিয়ে আমি ‘পাতা ছেঁড়া যাবে না’ লেখা একটি গ্রাফিতি দেখেছিলাম। “ওই গ্রাফিতি এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা বলে, সাম্যের বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখায়। সে সময় দেয়ালে দেয়ালে তরুণরা যেভাবে তাদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছে, তা অভূতপূর্ব।” নবম-দশম শ্রেণির ‘বাংলা ব্যাকারণ ও নির্মিতি’ বইয়ের শেষ প্রচ্ছদে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত এই গ্রাফিতিটি স্থান দেয় এবং পরে আবার ‘চাপে পড়ে’ বদলেও দেয় এনসিটিবি। নবম-দশম শ্রেণির ‘বাংলা ব্যাকারণ ও নির্মিতি’ বইয়ের শেষ প্রচ্ছদে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত এই গ্রাফিতিটি স্থান দেয় এবং পরে আবার ‘চাপে পড়ে’ বদলেও দেয় এনসিটিবি। রশীদ আমিন যে গ্রাফিতিটির কথা বলছিলেন, সেটি পাঠ্য বইয়ের মলাটেও স্থান পেয়েছিল। গত জানুয়ারিতে নবম-দশম শ্রেণির বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে ‘আদিবাসী’ শব্দ সংবলিত চিত্রকর্মটি স্থান পায়। সেই চিত্রে ছিল একটি গাছের পাঁচটি পাতা; যেখানে লেখা ছিল মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও আদিবাসী; পাশে লেখা ছিল ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’। কিন্তু ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’ নামে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা একটি প্ল্যাটফর্মের কর্মীরা আপত্তি তোলেন। তাদের দাবির মুখে ওই ছবি পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়া হয়। আদিবাসী শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানাতে পথে নামলে তাদের ওপর হামলাও হয়। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গ্রাফিতিতে যা বলা হয়েছিল, তা তো এখন আর কার্যকর নাই। দেয়ালে দেয়ালে যে গ্রাফিতি আঁকা হয়েছিল, তাতে জনগণ কী চায় তারই প্রকাশ হয়েছিল। কিন্তু সেই গ্রাফিতি একটা অশুভ শক্তি খেয়ে ফেলেছে এবং মানুষের আকাঙ্ক্ষা-আশা-প্রত্যাশাকেও খেয়ে ফেলা হচ্ছে।” সরকার বিভিন্ন সংস্কার কমিশন করেছে, গঠন করেছে জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন। সেসব কমিশনে যে আদিবাসীদের কাউকে যুক্ত করা হয়নি, সে বিষয়টি চোখে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন তিনি। বুঝতে হবে সেই ভাষা অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে দেয়ালগুলো হয়ে উঠেছিল সাধারণ মানুষের কথা প্রকাশের ক্যানভাস; প্রতিবাদের অংশ। “প্রথম পর্যায়ে যে দেয়ালচিত্র আঁকা হয়, তাতে ক্রোধ, যন্ত্রণা, কান্না ফুটে উঠেছিল। এখানে দ্রুত লেখা কথা ও গালিই ছিল তাৎক্ষণিক স্বতঃস্ফূর্ত ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। চারুকলার শিক্ষার্থী বা আঁকতে জানেন, এমন মানুষও অংশগ্রহণ করেন। হত্যা, নির্যাতন, পুলিশি জুলুম, গ্রেপ্তার সম্পর্কে লেখা ও আঁকা হয়েছিল।” ৫ অগাস্টের পর এর অনেকগুলো মুছে ফেলা হয়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “অনেকের চোখে প্রতিবাদের এই নির্জলা প্রকাশ শোভন মনে হয়নি।” জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক। তিনি বলেন, “দ্বিতীয় পর্যায়ে আবার দেয়াল লিখন বা আঁকার কাজ শুরু হয়। দলবেঁধে যারা আঁকতে আসেন, তাদের আর ভীতির পরিবেশে কাজ করতে হয়নি। ফলে জুলাইয়ের ভয়াবহতা যেমন তারা এঁকেছেন, তেমনি তাদের স্বপ্নও এঁকেছেন নানান রঙে। “একটি নতুন দেশের স্বপ্ন, সকল মানুষের অধিকার, নারীর সমতা, বিভিন্ন জাতির ও ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণ, মনীষীদের বাণী, গানের লাইন সবই আছে সেখানে। এই ক্যানভাসটা অনেক বড়। এই স্বপ্নের পুরোটা অর্জন করতে হলে বিশাল একটি উদ্যোগ দরকার, যা এই এক বছরেই অর্জন করা গেছে বলে মনে হয় না। আরও আছে ‘বিচার চাই’ কথাটা। এটা বারবারই লেখা। বিচারের কিছু উদ্যোগ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তিনিও বলছেন, জুলাইয়ে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচনা করা যায় দেয়ালে দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতিগুলোকে। তবে তিনি মনে করেন, অভ্যুত্থানের পর ‘অনেক কিছু অস্বীকার করার’ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আর সেটা সরকারের ‘প্রশ্রয়েই’ হচ্ছে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “জুলাই অভ্যুত্থানে মানুষের যে অংশগ্রহণ ছিল, তা বোঝা যায় গ্রাফিতিগুলো দেখলে। কোথাও কোথাও গ্রাফিতি মুছে দেওয়া হয়েছে এবং শক্তি খাটিয়ে অন্য গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে। “জুলাইয়ে নারীদের যে অংশগ্রহণ, তাও অস্বীকার করার প্রবণতা দেখছি। ইতিহাসের দায় থেকেই জুলাইয়ের নির্মোহ ইতিহাস রচনা করতে হবে।” টিএসসির সামনের দেয়ালে গ্রাফিতিতে আঁকা লেখা হয় ‘৩৬ জুলাই’। টিএসসির সামনের দেয়ালে গ্রাফিতিতে আঁকা লেখা হয় ‘৩৬ জুলাই’। জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় থাকা লেখক-সাংবাদিক এহসান মাহমুদ বলছেন, গ্রাফিতি বা দেয়ালচিত্রগুলো আর্কাইভ করার ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ ‘যথেষ্ট নয়’। গ্রাফিতির মধ্য দিয়ে যে জনগণের প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই ‘পূরণ হয়নি’। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা দেখেছি কোথাও কোথাও পরিকল্পিতভাবে গ্রাফিতি বিকৃত করা হয়েছে বা নষ্ট করা হয়েছে। গ্রাফিতি নিয়ে কয়েকটা বই বেরিয়েছে। তবে বড় পরিসরে কোনো কাজ এখনো দৃশ্যমান হয়নি।” রাজনৈতিক ইতিহাসের দায় থেকে গ্রাফিতির ভাষা বুঝতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আন্দোলনের পর মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যা এঁকেছিল, তা কোথাও কোথাও মুছে দিয়ে সেখানে অন্য ছবিও আঁকা হয়েছে। এই রাজনীতিটাও বুঝতে হবে।” শুধু সরকারি উদ্যোগে নয়, জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে বেসরকারি উদ্যোগেও নির্মোহ গবেষণা করার কথা বলেন তিনি। মেট্রোরেলের পিলারে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের পেছনে ফিরে দেখা জুলাই অভ্যুথানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ঢাকার মেট্রোরেলের পিলারে তুলে ধরা হয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের বছরওয়ারী চিত্র; যেটির নামকরণ করা হয়েছে ‘ফিরে দেখা ফ্যাসিস্ট রেজিম’ ও ‘জাগ্রত জুলাই’। নতুন গ্রাফিতি আঁকার কারণে ২০২৪ সালেরৈ ৫ অগাস্টের পর সাধারণ জনতা মেট্রোরেলের পিলারে যেসব গ্রাফিতি এঁকেছিলেন এক বছরের মাথায় সেগুলো মুছে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নতুন গ্রাফিতি আঁকা হচ্ছে। ইতোমধ্যে আঁকা হয়েছে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। কোথাও খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, শেয়ারবাজার ধস, ইলিয়াস আলী ‘গুম’, শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ছবি আঁকা হয়েছে। এছাড়া রিজার্ভ চুরি, হলি আর্টিসানে হামলা, প্রশ্নপত্র ফাঁস, খালেদা জিয়ার কারাবরণ, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কালো আইন, কোভিডের অব্যস্থাপনা, মুজিববর্ষে বিপুল ব্যয়, জ্বালানি সংকট, আবরার হত্যা, একরামুল হত্যা, কোটা সংস্কার আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, নাসিরনগরে হামলা, তনু ধর্ষণ, বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ড, ফেলানী হত্যাকাণ্ড, বিরোধীদলের নেতাদের গ্রেপ্তারের মত ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছে পিলারগুলোতে। মেট্রোরেলের গ্রাফিতিতে স্থান পেয়েছেন জুলাই আন্দোলনের নেতা নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলমরাও। মেট্রোরেলের গ্রাফিতিতে স্থান পেয়েছেন জুলাই আন্দোলনের নেতা নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলমরাও। ফার্মগেট থেকে মণিপুরি পাড়া হয়ে আগারগাঁও পর্যন্ত গেলে চোখে পড়বে জুলাই আন্দোলনের সময়ের নানা ঘটনা; যার মধ্যে একটি ছবিতে দেখা যায়- জুলাই আন্দোলনের নেতা নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলমদেরও। ‘জাগ্রত জুলাইয়ের দিন’ শিরোনামে আন্দোলনের দিনলিপি তুলে ধরা হয়েছে এসব গ্রাফিতিতে। ‘বাংলা ব্লকেড’ এর মত নানা আলোচিত কর্মসূচির ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছে গ্রাফিতিতে। জুলাই আন্দোলনের সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন- ‘তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতি চাকরি পাবে?’- সেটিও আঁকা হয়েছে একটি গ্রাফিতিতে। ওই সময়কালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছিলেন, ‘শিক্ষার্থিরা লিমিট ক্রস করে যাচ্ছে’। সে কথাও লেখা হয়েছে। শিক্ষার্থিদের উপর ছাত্রলীগের হামলার দৃশ্যও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ‘ব্লগার হত্যা’র গ্রাফিতি মুছে দিল কারা? কাওরানবাজার থেকে মেট্রোরেলের পিলারে গ্রাফিতি আঁকার কাজ শুরু হয় সপ্তাহ দুয়েক আগে; তখন ৪৬৪ নম্বর পিলারে আঁকা হয়েছিল ‘ব্লগার হত্যাকাণ্ড’ নামে একটি গ্রাফিতি। অন্যসব পিলারের গ্রাফিতি ঠিক থাকলেও সপ্তাহখানেক আগে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের গ্রাফিতিটা কে বা কারা মুছে দিয়ে সেখানে লিখে রাখে ‘তৌহিদী জনতার বাংলায় নাস্তিক শাতিমের ঠাঁই নাই।’ নিচে লেখা হয়- ‘মুসলিমবঙ্গ’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রাফিতিটি মুছে দেওয়ার ঘটনা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ২০১৩ থেকে বাংলাদেশে ব্লগার হত্যাকাণ্ড শুরু হয়। ওই বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ৭ অগাস্ট পর্যন্ত ১২ জন ব্লগারকে হত্যা করা হয়। ওইসব হত্যাকাণ্ডে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আনসার আল ইসলামসহ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের নাম উঠে আসে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ঘটা ব্লগার হত্যার সেই কথা স্মরণ করাতেই গ্রাফিতিটি আঁকা হয়েছিল। শুক্রবার সন্ধ্যায় সরেজমিনে দেখা যায়, ‘তৌহিদী জনতা’ গ্রাফিতিটি মুছে দেওয়ার পর সেখানে আর নতুন কোনো গ্রাফিতি আঁকা হয়নি। অন্যান্য পিলারে একাধিক গ্রাফিতি থাকলেও ৪৬৪ নম্বরে পিলারের দু’দিকে ‘সন্ত্রাস’ নামে একটি গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে। আর যে জায়গায় ছিল ব্লগার হত্যার গ্রাফিতি, সেই জায়গাটি সাদা করে রাখা আছে। চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অ্যাক্টিভিস্ট অপরাজিতা সংগীতা ফেইসবুকে লেখেন, “তৌহিদী জনতা ব্লগারদের গ্রাফিতি মুছে দিয়ে লিখেছে- ‘তাদের বাংলায় নান্তিক শাতিমের ঠাঁই নাই’। এখানে কি তৌহিদী জনতা স্বীকার করে নিল যে ব্লগারদের তারাই হত্যা করেছিলেন?” গ্রাফিতি ও জুলাইয়ের ইতিহাস সংরক্ষণ কতদূর? ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের শিক্ষক, কবি ও গল্পকার সুমন রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গ্রাফিতি তো চিরস্থায়ী কোনো ব্যাপার নয়, এটা সময়ের একটি ভাষা। ফলে দেয়ালে যেভাবে আছে, সেভাবেই সংরক্ষণ করতে হবে বলে মনে করি না। ফলে নানান ফরম্যাটে সংরক্ষণ করা সম্ভব।” গ্রাফিতি নিয়ে বাংলা একাডেমির গবেষণা প্রকল্পে একাধিক গবেষণার কাজ চলমান আছে জানিয়ে একাডেমির নির্বাহী পরিষদ ও সংস্কার কমিটির এই সদস্য বলেন, “সেগুলো হয়ত ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হবে। গবেষণার কাজ তো আর দ্রুত করে ফেলা যায় না। গ্রাফিতির সংরক্ষণে জুলাই জাদুঘরও কিছু পরিকল্পনা করেছে বলে জানি।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির দেয়ালে আবু সাঈদের গ্রাফিতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির দেয়ালে আবু সাঈদের গ্রাফিতি। দেয়ালে দেয়ালে মানুষ যে প্রত্যাশার বার্তা দিয়েছে, তা কিছু ক্ষেত্রে পূরণ হয়েছে বলেও মনে করেন সুমন রহমান। তিনি বলেন, “অভ্যুত্থানের সময়ের বাস্তবতা একরকম, এখন বাস্তবতা আরেক রকম। বাস্তবতা পাল্টাবে–এটা স্বাভাবিক। এক বছর আগে মানুষ, বিশেষ করে তরুণরা ছবি এঁকে যে বার্তা দিয়েছিল, তার কিছু কিছু জায়গায় হয়ত বাস্তবায়ন হয়েছে। আবার কিছু জায়গায় বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। “একসঙ্গে সবটা বাস্তবায়ন সম্ভবও নয়। এটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। পরিবর্তনের ধারাটি চলমান আছে বলেই আমি মনে করি। সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। ফলে গ্রাফিতির মধ্য দিয়ে মানুষ যে প্রত্যাশার কথা বলেছে, সেই পথেই বাংলাদেশ হাঁটবে বলে আমার বিশ্বাস।” চিত্রশিল্পী রশীদ আমিন বলেন, “গ্রাফিতি বা দেয়ালচিত্রগুলো তো অস্থায়ী শিল্পকর্ম। দু-এক বছর পরই হয়তো আর থাকবে না। তাই ছবি তুলে নিয়ে সিরিজ আকারে বই প্রকাশ করা উচিত। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গবেষণা করা উচিত।” অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত সেপ্টেম্বরে ঘোষণা এসেছিল, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন ‘গণভবন’কে জুলাই জাদুঘরে রূপান্তর করা হবে। জুলাই জাদুঘরের প্রধান কিউরেটর তানজিম ওয়াহাব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জুলাই স্মৃতি জাদুঘরের আর্কাইভ ও কালেকশন টিম দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জুলাইয়ের স্মৃতি সংগ্রহের জন্য জুলাই আন্দোলনের ছবি, ভিডিও এবং আন্দোলনের নানা উপকরণ, চিঠি ইত্যাদি সংগ্রহ করছে।” এ পর্যন্ত কতগুলো স্মারক সংগৃহীত হয়েছে জানতে চাইলে তানজিম বলেন, “এটি চলমান প্রক্রিয়া, জাদুঘর উদ্বোধন হওয়ার পরও স্মারক সংগ্রহ করা হবে। সেখানে গ্রাফিতি সংরক্ষণের ব্যাপারটিও আছে।” জুলাইয়ের স্মৃতি স্মারক ও ইতিহাস সংরক্ষণে সরকারের কার্যক্রমে কতটা সন্তুষ্ট, জানতে চাইলে জুলাই আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার জুলাই জাদুঘরের কাজ অনেকটা গুছিয়ে এনেছে বলে জেনেছি। এছাড়া বেসরকারিভাবে অনেক উদ্যোগ আছে। “সরকার জুলাই জাদুঘর উদ্বোধন করবে। এরপর আসলে বোঝা যাবে কতটা ইতিহাস সংরক্ষণ করা হয়েছে। সেটা আশা করি এই মাসেই সবার সামনে দৃশ্যমান হবে। আর আশা করি ধারাবাহিকভাবে প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নেওয়া হবে।” জুলাইয়ের ইতিহাস সংরক্ষণের দায়িত্ব সরকারের পাশাপাশি গবেষকসহ অন্যদেরও নিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *