ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। এরই অংশ হিসাবে রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে নৃশংসভাবে খুনের ঘটনা বেছে নিয়েছে একটি গোষ্ঠী বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা।
তাদের মতে, এই ষড়যন্ত্রকারীদের মূল টার্গেট বিএনপি। পরিকল্পিতভাবে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য চক্রটি এই হত্যাকাণ্ডকে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নে ব্যবহার করছে কিনা-তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জাতীয় রাজনীতি ও বিএনপির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। অথচ রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপি এ হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ ও জড়িতদের দৃষ্টামূলক শাস্তি দাবি করছে। এ ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলার আলোকে আজীবন বহিষ্কারের মতো সর্বোচ্চ সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। একই সঙ্গে বর্তমান সরকারের কাছে হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিও জানিয়েছে। তারপরও বিএনপির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির ট্যাগ দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা চালানো হচ্ছে। যা দেশের গণতন্ত্র ও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য ভয়ংকর অশনিসংকেত।
বিএনপি মনে করে, অপরাধী যেই হোক সে আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী। কোনো অপরাধীর দলীয় পরিচয় নেই। তার দলীয় পরিচয় অপ্রয়োজনীয় এবং তার অপরাধের সঙ্গে দলের কোনো সম্পর্ক নেই। হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দ্রুত কার্যকরের বিষয়ে দলীয় অবস্থান সুদৃঢ় এবং অপরিবর্তিত। যেখানে পুলিশ বলছে এ হত্যাকাণ্ড ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণে, এর সঙ্গে চাঁদাবাজির কোনো সম্পর্ক নেই। সেখানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একটি মহল বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। বিএনপি নেতারা বলেন, বেশ কয়েকটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য রাখা দরকার। তা হলো এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার হচ্ছে কিনা। জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশকে বিঘ্নিত করার জন্য এ ঘটনাটিকে অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা। দেশের অন্যান্য স্থানে সংঘটিত যেমন-কুমিল্লায় মসজিদের ইমাম হত্যা, খুলনায় হত্যা ও রগকাটা-এমন হত্যাকাণ্ডের বিপরীতে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর সমমানের, নাকি পক্ষপাতদুষ্ট? প্রকাশ্য দিবালোকে অসংখ্য মানুষের সামনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিকটবর্তী অবস্থান থাকা সত্ত্বেও এরূপ ঘটনার কোনো প্রতিরোধ না হওয়ায় জনমনে প্রশ্নের জন্ম নিচ্ছে।
দলটির মতে, জনসম্মুখে এরূপ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ ছাড়া বিনা বাধায় ভিডিও ধারণ করা হচ্ছে। যা কোনো ষড়যন্ত্রের বার্তা বহন করে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মাত্র গুটিকয়েক সন্ত্রাসী প্রকাশ্যে এমন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে। যা এক বছর আগে সংঘটিত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সম্পূর্ণ বিপরীতে ফের আইনের শাসন ধ্বংসের ষড়যন্ত্র। সরকার পরিচালনার দায়িত্বে না থাকা সত্ত্বেও কোনো রাজনৈতিক দল ও নেতাকে দায়ী করে বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন জাতীয় নির্বাচনের জনআকাঙ্ক্ষাকে নস্যাৎ করার পরিকল্পনা কিনা। দেশে সুস্থধারার রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়তার বিরুদ্ধে পরিকল্পিত অপপ্রচারের মাধ্যমে আবারও ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও আওয়ামী লীগের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ। শেষ কথা অপরাধীর জন্য কোনো অনুকম্পার সুযোগ নেই। পক্ষাবলম্বনের প্রশ্নই উঠে না। এরূপ অনমনীয় দৃঢ় পদক্ষেপকে স্বাগত না জানিয়ে পরিকল্পিতভাবে চরিত্র হনন; দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের আইনি সহায়তা প্রদানের অঙ্গীকার থেকে তাদের বিরত হওয়ার সুযোগ নেই। সেটা সোহাগ তাদের দলীয় কর্মী বলে নয়, বরং দেশের একজন নাগরিক যিনি সন্ত্রাসের নির্মম শিকার।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম মনে করেন, এই হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দ্রুত কার্যকর করার বিষয়ে বিএনপির অবস্থান সুদৃঢ় এবং অপরিবর্তিত। কিন্তু এটা নিয়ে যারা রাজনৈতিক পরিবেশ নষ্ট এবং জাতীয় নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত ও অনিশ্চিত করতে চান এবং প্রকারান্তরে ফ্যাসিবাদ উত্থানের পথ কারা সৃষ্টি করতে চায়, তাদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। শত বাধা অতিক্রম করে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দেশের মালিকানা দেশের মানুষের কাছে ফেরত দেওয়াই একমাত্র অগ্রাধিকার। বিএনপির বিগত ১৭ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামে অর্জিত সফলতা ব্যর্থ করার সুযোগ নেই।
তিনি আরও মনে করেন, সামান্য কিছু রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রকারীর অপচেষ্টায় বাংলাদেশ ব্যর্থ হতে পারে না। যে তারুণ্য ফ্যাসিবাদের পতনে অগ্রসৈনিক ছিল, আজকে দেশের প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে বিএনপির সবার ঐক্যবদ্ধ চেষ্টা যে কোনো মূল্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে। ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশে ষড়যন্ত্র কোনো বাধা হতে পারে না।
শনিবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) জসীম উদ্দিন বলেন, সোহাগ হত্যাকাণ্ডের প্রাথমিক তদন্তে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় ব্যবসায়ী লাল চাঁদ সোহাগ হত্যাকাণ্ডের পেছনে চাঁদাবাজির কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি, বরং ভাঙারি ব্যবসা এবং একটি দোকানে কারা ব্যবসা করবে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। হত্যাকাণ্ডের শিকার সোহাগ এবং হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছে তাদের একসঙ্গে ব্যবসাও ছিল। জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি আব্দুল মোনায়েম মুন্না যুগান্তরকে বলেন, যারা প্রাণঘাতী আঘাতগুলো করেছে তারা অদ্যাবধি গ্রেফতারও হয়নি। এর কারণ বোধগম্য নয়। গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পেরেছি, মামলার এজাহারে খুনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত তিনজন খুনিকে পুলিশ কৌশলে বাদ দিয়ে নিরপরাধ তিনজনকে আসামি করেছে। ঘটনার পর ৬০ ঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও, খুনিদের খুনের প্রমাণাদি হাতে থাকা সত্ত্বেও অদ্যাবধি কেন মূল আসামিদের গ্রেফতার করা গেল না, এটা এক বিরাট প্রশ্ন ও রহস্য।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, বিএনপি কোনোদিন কোনো অন্যায়কে সমর্থন করেনি, কখনো করবে না। বিএনপি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা অতীতেও করেছে এবং এবারও করবে। কিন্তু নির্বাচন নেই বলে আজকে দেশে এই ঘটনাগুলো ঘটছে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে, মৃত্যু বাড়ছে। দুর্বৃত্তরা সুযোগ নিচ্ছে। এজন্যই অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে বাংলাদেশে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রকাঠামো পরিবর্তন করে একটা নির্বাচন দ্রুত চাই। কারণ গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। আর গণতন্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে নির্বাচন।
তিনি আরও বলেন, এই পৈশাচিক ঘটনা শুধু একটি জীবনহানিই নয়-এটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, নাগরিক অধিকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় গভীর হতাশার বহির্প্রকাশ। আমাদের সংগঠনের নীতি, আদর্শ ও রাজনীতির সঙ্গে সন্ত্রাস ও বর্বরতার কোনো সম্পর্ক নেই। অপরাধী যেই হোক, তার স্থান কখনোই আইন ও ন্যায়বিচারের ঊর্ধ্বে হতে পারে না। জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনে পতিত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর এই নির্মম ঘটনাটি দেশের মানুষের বিবেককে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। প্রকাশ্য দিবালোকে সংঘটিত পৈশাচিক ও ন্যক্কারজনক ঘটনাটির দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের সমাজকে আরও গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত করবে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী যুগান্তরকে বলেন, সোহাগ হত্যাকাণ্ডের ফায়দা লুটতে চাইছে কিছু রাজনৈতিক দল। দু-একটি রাজনৈতিক দল মিছিল করে বিএনপির ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে। আমরা যদি শেখ হাসিনার মতো নিশ্চুপ থাকতাম, অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতাম, তাদের বহিষ্কার না করতাম, তাহলে এক কথা ছিল। কিন্তু বিএনপি অবিলম্বে বিচার দাবি করেছে ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তাহলে তারা মিছিল করছেন কেন? তার মানে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিএনপির ইতিবাচক দিকগুলো উপেক্ষা করে যারা ফায়দা লুটতে চায়, জনগণ তাদের সফল হতে দেবে না।
Leave a Reply