রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের সভায় সিদ্ধান্ত : ইসি গঠনে স্পিকারের নেতৃত্বে বাছাই কমিটি

নির্বাচন কমিশন গঠনে স্পিকারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বাছাই কমিটি হবে। কমিটির অন্য সদস্যরা হবেন ডেপুটি স্পিকার (বিরোধীদলীয়), প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা এবং প্রধান বিচারপতির প্রতিনিধি হিসাবে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি। এ কমিটি নির্ধারিত পদ্ধতিতে সর্বসম্মতিক্রমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিশনারদের তালিকা তৈরি করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় এ বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন।

বৈঠক শেষে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, আজকের (বুধবার) আলোচনা ঐতিহাসিক অগ্রগতি তৈরি করেছে। আশা করছি, জুলাইয়ের মধ্যেই জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে। এ সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা শুধু সংবিধানে উল্লেখ থাকলেই যথেষ্ট নয়। উপযুক্ত নিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এর কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, দীর্ঘ আলোচনার পর আমরা একটি ঐকমত্যে পৌঁছেছি। সিদ্ধান্ত হলো-আগে নির্বাচন কমিশন গঠন আইন দ্বারা নির্ধারিত ছিল, এখন সেটি সংবিধানে যুক্ত হয়েছে।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের বুধবারের আলোচনায় নির্বাচন কমিশনের প্রধান এবং অন্য কমিশনারদের নিয়োগ বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিদ্যমান সংবিধানের ১১৮(১) সংশোধন করে নতুন সংশোধিত প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে। সংশোধিত প্রস্তাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং আইনে নির্ধারিত সংখ্যক নির্বাচন কমিশনারের সমন্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন কমিশন থাকবে। তিনি বলেন, স্পিকারের নেতৃত্বে ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি বাছাই কমিটি হবে। ওই কমিটি বিদায়ি কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিন আগেই পরবর্তী ৫ বছরের জন্য নতুন কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেবে। এক্ষেত্রে সংসদে প্রণীত আইন দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে ‘ইচ্ছাপত্র’, প্রার্থীর সংশ্লিষ্ট তথ্য আহ্বান করাসহ কমিটি উপযুক্ত প্রার্থী অনুসন্ধান করবে।

আলী রীয়াজ আরও বলেন, উল্লিখিত কমিটি আইনের দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে অনুসন্ধানে প্রাপ্ত ব্যক্তিদের জীবনবৃত্তান্ত স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাই করবে। এরপর সর্বসম্মতিক্রমে তাদের মধ্য থেকে একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্ধারিত প্রতিটি পদের বিপরীতে একজন করে নির্বাচন কমিশনার হিসাবে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে। রাষ্ট্রপতি তাদের কার্যভার গ্রহণের তারিখ থেকে পরবর্তী ৫ বছরের জন্য নিয়োগ দেবেন। স্পিকারের তত্ত্বাবধানে জাতীয় সংসদ সচিবালয় এ কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবে। তিনি বলেন, বিদায়ি কমিশনের মেয়াদ শেষ হলে অথবা অন্য কোনো কারণে পদ শূন্য হলে পরবর্তী দিন থেকে নতুন কমিশন দায়িত্ব নেবে। এছাড়া জাতীয় সংসদের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের ওপর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পৃথক আইন ও আচরণবিধি প্রণয়নের বাধ্যবাধকতা সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে বিদ্যমান সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের উপ-অনুচ্ছেদ ২, ৩, ৪, ৫ ও ৬ অপরিবর্তিত থাকবে। তিনি বলেন, আজকের (বুধবার) আলোচনা ছিল অত্যন্ত ফলপ্রসূ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের আগের অবস্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছাড় দিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। আলী রীয়াজ বলেন, জুলাইয়ের মধ্যেই জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে। আশা করছি, শিগ্গিরই আমরা জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় সনদে উপনীত হতে পারব।

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘অতীতে আমরা বলেছি, প্রতিটি সাংবিধানিক এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের জন্য সংবিধানে আলাদা করে নিয়োগ প্রক্রিয়া দরকার নেই। সংশ্লিষ্ট আইনের মাধ্যমে সেসব প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আচরণবিধি নিশ্চিত করতে হবে। তবে নির্বাচন কমিশনের বিষয়টি সংবিধানে আলাদা করে উল্লেখ করা যায়। এক্ষেত্রে আমরা একমত।’ তিনি বলেন, সংলাপে সব পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাব চূড়ান্ত হয়েছে। এর আগে প্রতিটি পদের জন্য দুটি করে নাম সুপারিশের কথা ছিল। কিন্তু বর্তমান প্রস্তাবে সেটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন প্রতিটি পদের জন্য একটি করে নাম রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। এই সার্চ কমিটি নির্বাচন কমিশনের জন্য প্রার্থী খুঁজে বের করতে একটি অনুসন্ধান পরিচালনা করবে। সেখানে সিভিল সোসাইটি, রাজনৈতিক দল ও সাধারণ জনগণ নাম জমা দিতে পারবে। সংসদে একটি আইন প্রণয়ন করে সার্চ কমিটির কাঠামো নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।

বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, ‘সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের উপধারায় একটি নতুন সংযোজনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সংসদ নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আইন প্রণয়ন এবং তাদের জন্য আচরণবিধি নির্ধারণ করবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এমন একটি নির্বাচন কমিশন চাই, যারা কার্যত স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে। তাই তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে কার্যক্রম পর্যন্ত সবখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকতে হবে। অতীতে আমরা দেখেছি, একাধিকবার নির্বাচন কমিশন গঠন হয়েছে। তবে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি।’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমাদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। জাতি আজ ঐক্যবদ্ধভাবে সে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। এখন শুধু আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া বাকি। আমরা ধরে নিচ্ছি, পরবর্তী নির্বাচন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হবে। সেই বিবেচনায় একটি কার্যকর, স্বাধীন এবং জবাবদিহিমূলক নির্বাচন কমিশন গঠনে যে অগ্রগতি হয়েছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গঠিত ঐক্যকে তিনি স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘এই গঠনপ্রক্রিয়া এবং কমিশনের ভবিষ্যৎ কাজের দিকনির্দেশনা নির্ধারণে যে সর্বসম্মত প্রস্তাব এসেছে, তা একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ভিত্তি তৈরি করবে।’

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, দীর্ঘ আলোচনার পর আমরা একটি ঐকমত্যে পৌঁছেছি। সিদ্ধান্ত হলো-আগে নির্বাচন কমিশন গঠন আইন দ্বারা নির্ধারিত ছিল, এখন তা সংবিধানের আওতায় আসবে। আগে নির্বাচন কমিশনের জবাবদিহিতা ছিল না। মেয়াদ শেষ হলে তাদের ধরার সুযোগ ছিল না। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের আচরণবিধি, অপসারণ এবং জবাবদিহিতার বিষয়টি সামনে এনেছি। জবাবদিহির বিষয়ে নতুন করে একটি আইন তৈরি হবে। ওই আইনের মাধ্যমে তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত। একটু আলোচনা বাকি আছে। সেটি শেষ করে সবাইকে জানানো যাবে।

বুধবার ছিল কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের দ্বিতীয় পর্যায়ের ১৮তম দিনের আলোচনা। এ সময় কমিশনের সদস্য হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রোববারের আলোচনায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। এর মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি এবং আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি অন্যতম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *