ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মিত্রসহ ধর্মভিত্তিক ইসলামি দল ও সংগঠনের সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। এর মধ্য দিয়ে জোট কিংবা নির্বাচনি সমঝোতার বিষয়টি আরও স্পষ্ট হতে পারে। পর্যায়ক্রমে আরও ইসলামি দল ও সংগঠনের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক করার কথা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
যদিও বিএনপির নেতারা বলছেন, হেফাজত, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন ও ছারছীনা পীরের সঙ্গে যে বৈঠক হয়েছে, সেখানে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। তারা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সালাম পৌঁছে দিয়েছেন।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল বলছে, বিএনপির মিত্র রাজনৈতিক দল তো রয়েছেই। পাশাপাশি আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি দেশের আলেম-ওলামা, ইসলামি দল ও সংগঠনগুলোর সঙ্গে অধিকতর যোগাযোগ ও সম্পর্ক উন্নয়ন এবং আলেমসমাজের জোরালো সমর্থন লাভের লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অরাজনৈতিক বৃহৎ ইসলামী শক্তি হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুইজন নেতা তারেক রহমানের তরফ থেকে সাক্ষাৎ করেন। তাছাড়া সম্প্রতি হেফাজতের উদ্যোগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের অফিস খোলার চুক্তি সম্পর্কে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বিএনপির পক্ষ থেকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ অংশগ্রহণ করেন এবং হেফাজতের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। ছারছীনা দরবার শরিফের পীর মুফতি শাহ আবু নছর নেছারউদ্দীন আহমাদ হুসাইনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে তাদের বড় ভোটব্যাংক রয়েছে।
এছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই নেতা। এ সংগঠনটি ২০ হাজার দরবার, ২০ হাজার প্রতিষ্ঠান ও ৫৫ লাখ ছাত্রছাত্রীর প্রতিনিধিত্ব করে বলে তাদের নেতারা জানিয়েছেন।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, ইসলামপন্থি-সব মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। হাটহাজারী মাদ্রাসায় গিয়েছিলাম, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমিরের সঙ্গে দেখা করেছি, কথা বলেছি। ছারছীনা পীরের সঙ্গে দেখা করেছি; আলিয়া মাদ্রাসাধারার যেসব মুরুব্বি আছেন, তাদের সঙ্গে দেখা করেছি, কথা বলেছি। উদ্দেশ্য একটাই-বাংলাদেশের সব জনগোষ্ঠীকে আমরা একত্রিত করে, ঐক্যবদ্ধ করে এমনভাবে দেশ পরিচালনা করতে চাই, যেখানে বিভক্তি থাকবে না। সবাইকে একত্রে ধারণ করে, বাংলাদেশের গণমুখী চেতনাকে ধারণ করে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ধারায় রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চাই। সেজন্য আমরা রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠে সব মতাদর্শের মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। যাতে সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে জাতীয় ঐক্য সমুন্নত করা যায়, দৃঢ় করা যায়। বিভক্তি নয়, আমরা চাই ঐক্য।’
রমজানের আগে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিএনপির নেতাদের মতে, যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনি পথ পাড়ি দিতে চায় বিএনপি। জনগণের ভোটে বিজয়ী হলে এসব দলকে সঙ্গে নিয়েই জাতীয় সরকার গঠন করতে চায় দলটি। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের এই চাওয়া অনুযায়ী আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মিত্রদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে আসন বণ্টন করবে বিএনপি। এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপি ও লেবার পার্টির সঙ্গে মতবিনিময় করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আজ ৫ দলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে। মিত্রদের সঙ্গে বৈঠকের পর জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিসহ বেশ কয়েকটি ইসলামপন্থি ও বামপন্থি রাজনৈতিক দলকেও তাদের নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাবছে বিএনপি। তবে এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে রাখার বিষয়ে এ পর্যন্ত কোনো ভাবনা নেই দলটির। তবে আদর্শিকভাবে জামায়াতবিরোধী ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনকে পাশে রাখতে চায় বিএনপি। এরই অংশ হিসাবে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দল ও সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছেন দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে কমিশনকে চিঠি পাঠিয়ে নির্বাচন আয়োজনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে সংশয় ছিল, তা অনেকটাই কেটে গেছে। প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনের ঘোষণা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দিক থেকে কোনো আপত্তি আসেনি। বরং অনেক দলই প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনি ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। সব দল এখন নির্বাচনমুখী। রাজনৈতিক মহলের পর্যবেক্ষণ, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে পতিত এবং বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন স্থগিত হওয়া আওয়ামী লীগ এবার নির্বাচনে থাকছে না। এ অবস্থায় নির্বাচনের সমীকরণ কী হবে, এ নিয়ে চলছে নানা মহলের হিসাবনিকাশ। বিএনপি বড় দল হিসাবে জোট করার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়া কোনো কোনো দলের সঙ্গে নির্বাচনি সমঝোতায়ও যেতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১ আগস্ট হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির প্রবীণ ইসলামি ব্যক্তিত্ব আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও সালাহউদ্দিন আহমদ। উত্তর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বাবুনগর আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া আজিজুল উলুম মাদ্রাসায় অরাজনৈতিক এই বৃহৎ ইসলামি সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আমিরের সঙ্গে এই সাক্ষাৎ হয়। এ সময় বিএনপির দুই নীতিনির্ধারক দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের তরফ থেকে হেফাজতের আমিরকে সালাম পৌঁছে দেন এবং দোয়াও চান। হেফাজতের আমিরের স্বাস্থ্যগত অবস্থার খোঁজখবর নেন বিএনপির দুই নেতা। এছাড়া হাটহাজারীতে পৌঁছেই সেখানে হেফাজতে ইসলামের মরহুম আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী ও আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর কবর জিয়ারত করেন।
এর আগে ২৯ জুলাই রাজধানীর বনানীতে ছারছীনা দরবার শরিফে গিয়ে পীর মুফতি শাহ আবু নছর নেছারউদ্দীন আহমাদ হুসাইনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি ছারছীনা দরবার শরিফের পীরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন এবং একান্তে কথা বলেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সালাম ছারছীনা দরবার শরিফের পীরের কাছে পৌঁছে দেন।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাজধানীর মহাখালীতে গাউসুল আজম কমপ্লেক্সে মাদ্রাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম ও সালাহউদ্দিন আহমদ। এ সময় বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদর্রেছীনের সভাপতি এএমএম বাহাউদ্দীন বলেন, ২০ হাজার দরবার, ২০ হাজার প্রতিষ্ঠান ও ৫৫ লাখ ছাত্রছাত্রীর প্রতিনিধিত্ব করে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন। তিনি বিএনপি নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন, এদেশের আলেম-ওলামা, ২০ হাজার দরবার, ৫৫ লাখ ছাত্রছাত্রী তাদের অভিভাবক-সবাই মিলে তাদের সঙ্গে থাকবে, যারা সহিহ ইসলামের পক্ষে এবং ইসলাম নিয়ে যারা রাজনীতি করে না। তাদের পেছনে এদেশের লাখ লাখ হাক্কানি আলেম-ওলামার পাশাপাশি কোটি কোটি ভোটারও থাকবে।
Leave a Reply