ট্রমায় ভুগছে শিক্ষার্থীরা উদ্বিগ্ন অভিভাবক

উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় কোমলমতি শিশুদের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় শোকাহত দেশ। দগ্ধ ও আহতদের চিকিৎসায় চলছে সর্বাত্মক চেষ্টা। সিঙ্গাপুর থেকে এসেছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক টিম।

হতাহতদের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ এবং আহত, নিহত ও নিখোঁজদের নাম-ঠিকানাসহ তালিকা তৈরিতে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জিয়াউল আলমকে সভাপতি করে গঠিত কমিটিকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন-উপাধ্যক্ষ (প্রশাসন) মো. মাসুদ আলম, প্রধান শিক্ষিকা খাদিজা আক্তার, কো-অর্ডিনেটর লুৎফুন্নেসা লোপা, অভিভাবক প্রতিনিধি মনিরুজ্জামান মোল্লা (শিক্ষার্থী, যাইমা জাহান, চতুর্থ শ্রেণি) এবং দ্বাদশ শ্রেণির দুই শিক্ষার্থী মারুফ বিন জিয়াউর রহমান ও মো. ভাসনিম ভূঁইয়া প্রতীক। কমিটিকে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সরাসরি ঘটনাস্থল পরিদর্শন, সংশ্লিষ্ট পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ এবং নিশ্চিত তথ্য যাচাই করে তালিকা প্রস্তুত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এসবের মাঝে তিনদিন ধরে চলছে আহত ও নিহত পরিবারগুলোয় শোকের মাতম। সন্তান হারিয়ে দিশেহারা বাবা-মা। তাদের ব্যথা অবর্ণনীয়। খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন অনেকে। স্বাভাবিক জীবনে এমন আঘাত সইবার নয়। কে কাকে সান্ত্বনা দেবেন-সবাই আছেন চরম ট্রমায়। বিশেষ করে যে বাবা-মা তাদের একমাত্র সন্তান হারিয়েছেন কিংবা এক সন্তান বেঁচে আছে, সে পরিবারগুলোর অবস্থা অবর্ণনীয়। এমন পরিবারও আছে তিন সন্তানের সবাই মারা গেছে। পাশাপাশি যাদের সন্তান দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে, তাদের সবার মানসিক অবস্থা এতটাই নাজুক যে কারও সঙ্গে কথাও বলা যাচ্ছে না। তাদের মুখে কোনো ভাষা নেই। আছে উৎকণ্ঠার অপেক্ষা।

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা মাধ্যমের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহতাব উদ্দিন সাদাফ একটুর জন্য দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যায়। ছুটির পর ক্লাস থেকে মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে সাদাফ। তার চোখের সামনেই মুহূর্তের মধ্যে বিমানটি আছড়ে পড়ে। চোখের সামনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় বেশকিছু শিক্ষার্থী। আবার কেউ কেউ পোড়া শরীর নিয়ে দৌড়াচ্ছে-এমন দৃশ্য দেখতে পায় সাদাত। ঘটনার পর থেকে সে এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। খাওয়াদাওয়া ঠিকঠাক করছে না। আচরণে একধরনের অস্বাভাবিকতা। শঙ্কা আর ভয় নিয়ে সারাক্ষণ মায়ের আশপাশে থাকে। বুধবার মায়ের সঙ্গে কিছু সময়ের জন্য স্কুলে আসে সাদাফ। তবে ঢুকতে পারেনি। দূর থেকে উঁকি দিয়ে স্কুলের ভেতরে পরিস্থিতি দেখার চেষ্টা করে। সাদাফ যুগান্তরকে বলে, আমাদের ক্লাসের কেউ টিফিন, কেউ খেলায় ব্যস্ত ছিল। এ সময় ঘটল সেই মর্মান্তিক ঘটনা। আল্লাহ একটুর জন্য আমাকে বাঁচিয়ে দিলেও সহপাঠীদের করুণ মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না। সেদিনের দৃশ্য চোখের সামনে এলে স্থির থাকতে পারি না। সহপাঠী তাওহীদ আইসিইউতে আছে। আমার নিচের ক্লাসের অনেকেই মারা গেছে। অনেকের দেহ যেভাবে পুড়েছে যেন একেকজন ছাত্র একেকটা কালো ছাই।

এদিকে চোখের সামনে তিন বন্ধুকে হারিয়ে বাক্রুদ্ধ মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাহিম তাসকিন আহমেদ। আহত হয়ে নিজের বেঁচে থাকাকে অলৌকিক মনে করছে সে। যদিও আগুনের উত্তাপে নিজেও আক্রান্ত। তার এক কানের কিছু অংশ ঝলসে গেছে। বন্ধুদের হারানোর এমন করুণ ঘটনা মানতে পারছে না সে।

বেঁচে যাওয়া সপ্তম শ্রেণির তাসকিন এদিন দুপুরে নিজের অসুস্থতা নিয়ে কিছু সময়ের জন্য আসে স্কুল ক্যাম্পাসে। সে জানায়, আগুনের লেলিহান শিখা থেকে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করেছি, তা নিজেও কল্পনা করতে পারছি না। তার সঙ্গে একই ভবনের দোতলায় ক্লাস করছিল তিন বন্ধু। এ সময় হুড়োহুড়ি করে বের হতে গিয়ে সায়েন ইউসুফ, আফনান ফাইয়াজ ও তানভীর আগুনে পুড়ে মারা যায়। তাসকিনের অন্য দুই বন্ধু এরিকসন ও মাকিন মারাত্মক ক্ষত নিয়ে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। তাদেরও বাঁচার সম্ভাবনা কম বলে জানায় সে। সাদাত ও তাসকিনের মতো অনেকেই এরকম মানসিক ট্রমায় রয়েছে। তাদের সঙ্গে অভিভাবক ও শিক্ষকরাও মানসিক বিপর্যয়ে আছেন উৎকণ্ঠায়। সেদিনের ঘটনায় শুধু ওই স্কুলেরই নয়, দেশের অন্য শিক্ষার্থীরাও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে।

এদিকে উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মূল ফটক বুধবার দিনভর বন্ধ রাখা হয়। বন্ধ রয়েছে শিক্ষা কার্যক্রম, ক্যাম্পাসে নেই কোনো শিক্ষার্থীর উপস্থিতি। তবে প্রতিষ্ঠানটির সামনে গেটের বাইরের রাস্তাজুড়ে উৎসুক জনতা ও গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড়। কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। বুধবার সরেজমিন দেখা যায়, সকাল থেকে ফাঁকা থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ জড়ো হতে থাকে। স্কুল কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে এদিন কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. তৈয়বুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, মাইলস্টোনের ঘটনা একটি জাতীয় দুর্যোগ। এ ঘটনায় শুধু ওই স্কুলের শিক্ষার্থী নয়, দেশের শিক্ষার্থীরাও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। যারা এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা আরও ভেঙে পড়েছে। শিক্ষার্থীরা যেন এই মানসিক চাপ কাটিয়ে উঠতে পারে, সেজন্য তাদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের ওপর কোনো ধরনের চাপ সৃষ্টি করা যাবে না। এজন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এ ঘটনায় মানসিক স্বাস্থ্য সমিতি একটি জরুরি হটলাইন সেবা চালু করেছে। আহতের পরিবারের যে কেউ এই সেবা নিতে পারবে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সিলিং সেন্টারের সাবেক কনভেনার অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ যুগান্তরকে বলেন, বিমান দুর্ঘটনার পর যেসব শিক্ষার্থী মানসিক ট্রমায় আছে তাদের বিশেষভাবে যত্ন নিতে হবে। পরীক্ষা বা ক্লাসের পড়াশোনা নিয়ে কোনো ধরনের চাপ দেওয়া যাবে না। অন্তত এক মাস তাদের পছন্দের বিষয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। বেশি করে খেলাধুলা বা ফ্রি রাখতে হবে। এছাড়া স্কুলে ফ্রি কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষক ও অভিভাবকদের জন্য এ ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে বলে জানান তিনি।

সোমবার দুপুর ১টার পরের ঘটনা। শিক্ষার্থীরা তখনো ক্লাসে। কেউ কোচিংয়ে। কেউ টিফিন নিয়ে ব্যস্ত। ঠিক সে সময় বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানটি আছড়ে পড়ে স্কুলের হায়দার আলী ভবনের সামনে। মুহূর্তেই যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় ভবনের নিচতলার কয়েকটি শ্রেণিকক্ষ। যেখানে অবুঝ শিক্ষার্থীরা মনের আনন্দে কেউ টিফিন খাচ্ছিল। কেউ গল্প করছিল। স্কুলের সামনে দোলনায় কেউ দোল খাচ্ছিল। আবার ছুটির সময় হওয়ায় সন্তানদের নিতে অপেক্ষমাণ অনেক অভিভাবক। এমন এক সময়ে নেমে এলো সেই পোড়া কালো ভয়ংকর দুর্ঘটনা। বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় পাইলট, শিক্ষার্থীসহ ২৯ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে সরকার। এছাড়া আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে অনেক শিক্ষার্থী। হতাহতদের অধিকাংশই তৃতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রী। আছেন শিক্ষকও। তাদের বেশির ভাগেরই হাত, পা, মুখ, বুক, পিঠ ঝলসে গেছে।

এদিকে মাইলস্টোনের বিমান দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টস (বিএপি) জরুরি হটলাইন সেবা চালু করেছে। সকাল ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত ০১৮৩৫১৫৪৩৪১ নম্বরে, দুপুর ২টা থেকে ৬টা পর্যন্ত ০১৮৩৫১৫৩২৬২ নম্বরে এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ০১৮৩৫১৫৩০০৫ নম্বরে সেবা নিতে পারবে মাইলস্টোন স্কুলের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *