শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার কাচিকাটা ইউনিয়নের ১৫১ নম্বর উত্তর মাথাভাঙা মান্নান সরকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনটি গত ১৪ সেপ্টেম্বর পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এর পর থেকে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম বন্ধ।
বিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষককে পাশের একটি বিদ্যালয়ে সংযুক্ত করেছে শিক্ষা কার্যালয়। এমন অবস্থায় দিশাহারা অভিভাবকেরা আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ও পাশের জেলার বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় তাঁদের সন্তানদের ভর্তি করছেন।
ভেদরগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, কাচিকাটি ইউনিয়ন পদ্মা নদীর চরে অবস্থিত। ইউনিয়নটির একদিকে মুন্সিগঞ্জ ও আরেক দিকে চাঁদপুর জেলা। ওই এলাকার চারদিক দিয়ে পদ্মা নদী প্রবাহিত হয়েছে। ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর মাথাভাঙা চরবানিয়াল গ্রামে ৪০০ পরিবারের বসবাস। ওই গ্রামের বাসিন্দারা নদীতে মাছ শিকার ও কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁদের মধ্যে পড়ালেখার আগ্রহ কম। এ ছাড়া গ্রামটিতে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল না। ২০১৭ সালে ওই গ্রামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করে সরকার। ২০১৮ সাল থেকে বিদ্যালয়ে পাঠদান শুরু হয়। একতলা একটি পাকা ভবনের চারটি কক্ষে পাঠদান কার্যক্রম চলছিল। বিদ্যালয় ভবনটি ভাঙনের মুখে পড়লে গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে পাঠদান বন্ধ করে দেওয়া হয়। দুদিন পর বিদ্যালয়ের আসবাব ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। গত ১৪ সেপ্টেম্বর বিদ্যালয় ভবনটি নদীতে ভেঙে পড়ে। আস্তে আস্তে একতলা পাকা ওই ভবন নদীতে তলিয়ে যায়। বিলীন হয়ে যায় বিদ্যালয়ের ৩০ শতাংশ জমি।
এক মাস ধরে শিক্ষা কর্মকর্তা ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বিকল্প স্থানে বিদ্যালয় চালু করার জন্য জমি খুঁজতে থাকেন। কিন্তু জমি না পেয়ে আর বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালু করতে পারেননি। তাই ওই বিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষককে পাশের চরজিংকিং এলাকায় অবস্থিত ৪০ নম্বর ছয়ানি দুলারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মৌখিকভাবে সংযুক্ত করেছেন।
উত্তর মাথাভাঙা গ্রামের বাসিন্দারা জানান, এ বছর নদীভাঙনে ওই গ্রামের ৩০টি পরিবার গৃহহীন হয়েছে। ভাঙনের কবলে পড়ে বাড়িঘর সরিয়ে নিয়েছে আরও ৪৫টি পরিবার। ওই পরিবারগুলোর সন্তানেরা উত্তর মাথাভাঙা মান্নান সরকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করত। নদীভাঙনে বিদ্যালয় বিলীন ও অনেকের বসতবাড়ি বিলীন হওয়ায় তাঁরাও অনেকে এলাকা ছেড়েছেন। অনেকে এলাকা ছেড়ে মুন্সিগঞ্জ ও ঢাকায় চলে গেছেন। সেখানেই সন্তানদের স্কুল ও মাদ্রাসায় ভর্তি করছেন।
উত্তর মাথাভাঙা গ্রামের বাসিন্দা মকবুল দেওয়ানের ৩ একর ফসলি জমি ছিল। সেই জমিতে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাঁর দুই ছেলে উত্তর মাথাভাঙা মান্নান সরকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করত। নদীতে মকবুলের ফসলি জমি ও বসতবাড়ি বিলীন হয়েছে। পরিবার নিয়ে তিনি মুন্সিগঞ্জের টংগিবাড়িরর দীঘির পাড়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
মকবুল দেওয়ান বলেন, পাশের জেলার একটি এলাকায় আশ্রয় নিয়েছি। সেখানেই একটি স্কুলে দুই ছেলেকে ভর্তি করেছি। তবে কীভাবে সংসারের খরচ চালাব, সেই দুশ্চিন্তায় পড়েছি।
বিদ্যালয়টির পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছামিয়া পড়ালেখায় ভালো ছিল। পদ্মায় বিলীন হওয়ার পর পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার শঙ্কায় পরিবারের সদস্যরা মুন্সিগঞ্জের একটি আবাসিক মাদ্রাসায় তাকে ভর্তি করেছেন। ছামিয়ার বাবা ইউসুফ সরকার বলেন, এলাকায় পড়ালেখার বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় মেয়েকে পাশের জেলার একটি আবাসিক মাদ্রাসায় ভর্তি করেছি।
ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আল মামুন বলেন, ২০২৩ সাল থেকে বিদ্যালয়টি নদীভাঙনের কবলে পড়ে। তখন থেকেই শিক্ষার্থী কমতে থাকে। এ বছর শিক্ষার্থী ছিল ৫৩ জন। বিদ্যালয়ের সব জমি ও ভবন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। অনেক শিক্ষার্থীর বসতবাড়িও নদীতে বিলীন হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী আশপাশের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। অনেকে পরিবারের সঙ্গে এলাকা ছেড়েছে। এই বিদ্যালয়ের জমি যাঁরা দিয়েছিলেন, তাঁরা জমি দিতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু তার দূরত্ব ৫-৬ কিলোমিটার। একটি নদী পার হয়ে যাতায়াত করতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা কিছুটা বিপাকে পড়েছি। জানতে চাইলে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ছোবহান মুন্সি বলেন, ‘বিদ্যালয়টি নদীতে বিলীন হওয়ার পর থেকে আমরা সেটা চালু করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। চরাঞ্চলে একটি জমির সন্ধান পেয়েছিলাম। সেখানে জনবসতি কম। আর এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সেখানে যাতায়াত করা কষ্টসাধ্য হবে। সহজ যাতায়াত হবে, এমন বিকল্প স্থানে জমি খুঁজছি। এ বিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থী ছিল, তাদের আশপাশের বিদ্যালয়ে ভর্তি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যালয়টির তিনজন শিক্ষককে পাশের একটি বিদ্যালয়ে মৌখিক আদেশে সংযুক্ত করা হয়েছে।
















Leave a Reply